ছোট গল্প : প্রকৃতির নিষ্ঠুর চক্র

লিখেছেন লিখেছেন আমীর আজম ০৫ জুলাই, ২০১৫, ০৯:১৯:৩৮ রাত

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ। লেকচার গ্যালারিতে বসে আছে তমাল। স্যার বকবক করেই যাচ্ছে একটানা। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সে। নানা রকম চিন্তা ভাবনা ঘুরছে মাথার মধ্যে।

****************************

তখন ক্লাস টু তে পড়ে তমাল। স্কুলে একটা নাটক অনুষ্ঠিত হবে। তাকে অভিনয় করতে হবে ডাক্তারের চরিত্রে। অ্যাপ্রন গায়ে গলায় স্টেথিস্কোপ ঝুলানো ক্লাস টু তে পড়ুয়া ডাক্তার। ভাবতেই ভাল লাগছে। সেদিনের অভিনয় কেমন হয়েছিল মনে পড়ে না। এখনকার মতো তখন যদি প্রযুক্তি এতো উন্নত থাকতো তাহলে ভিডিও ফুটেজ টা দেখে বলা যেত। এখনো অ্যাপ্রন আর স্টেথিস্কোপ হাতে নিলে সেদিনের অভিনয়ের কথা মনে পড়ে যায় তমালের।

এই হাসপাতালের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তমালের।

ছোট বেলায় বাবা মারা যাওয়ার আগে এই হাসপাতালেই নাকি ছিলেন অনেকদিন। তমালের অবশ্য মনে পড়ে না। তবে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা রোগী গুলো দেখলে তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। হয়তো বাবাও এভাবেই শুয়ে ছিলেন ।

12 বছর আগে। তমালের মা অসুস্থ হয়ে যায় হঠাৎ। নিয়ে আসা হয় এই হাসপাতালে। ব্যাথায় কাঁতর মায়ের চিৎকার এখনো কানে বাজে তমালের। হাসপাতালে সিরিয়াস রোগী গুলো যখন চিৎকার করে সহ্য করতে পারে না তমাল। ইচ্ছে করে কান চেপে ধরে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। ইচ্ছে করে ছুটে যায় মায়ের কবরের পাশে। একটু প্রাণ ভরে কাঁদতে।

*********

উফফফ। খুব বিরক্ত লাগছে তমালের। আর কয়েকদিন পর ফাইনাল পরীক্ষা তার। এটা পাশ করতে পারলেই ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে। তাই এখন ক্লাস গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে করা দরকার। কিন্তু কিছুতেই মনোযোগ দেয়া যাচ্ছে না।

আচ্ছা ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করলে আবারো তো সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানো লাগবে। লাগলে লাগুক। এখন আর ভয় পায় না তমাল। ভাবনার সাগরে ডুব দেয় আবার।

**********

চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে আছে তমাল। আবারও একটা ঝামেলার মধ্যে পড়েছে সে। এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো।

আগামী দশ বারো দিন কারও সাথে দেখা করতে পারবে না সে। বলা চলে আড়াল করে রাখবে নিজেই নিজেকে। তারপর হঠাৎ একদিন হাজির হবে সবার সামনে । ততোদিনে সবাই সবকিছু ভুলে যাবে। কার কি রেজাল্ট সেটা নিয়ে আলোচনাও বন্ধ হবে।

এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর । ভাল করেছে সে। A+ পেয়েছে। এটা সবার জন্যে খুশির হলেও তার জন্য কিছুটা বিব্রতকর।

এই পরিস্থিতি শুরু হয়েছে ক্লাস ফাইভে। টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পর। বন্ধুরা আর শিক্ষকরা সবাই খুব খুশি। সবাই মিলে আবদার করে মিষ্টি খাওয়াতে হবে তাদেরকে। খুশি মনে বাড়িতে আসে তমাল। মাকে বলে মিষ্টি খাওয়ানোর কথা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মা। তমাল আর কথা বাড়ায় না। বয়স কম হলেও বাস্তবতা কি জিনিস ততোদিনে বুঝে গেছে সে।

বাবা মারা গেছে অনেক আগে। কোন রকম টেনেহিঁচড়ে সংসার চলছে। এ পরিস্থিতিতে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব না। লজ্জায় আর দশ বারো দিন ক্লাসে যায়নি সে।

এভাবে ক্লাস এইট, এসএসসি আর সর্বশেষ এইচএসসি তে একি পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে।

রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে তার। পরীক্ষার আগে কেন যে তার এই কথাটা মনে থাকে না। পরীক্ষার আগে শুধু মনে হয় তাকে অনেক বড় হতে হবে অনেক ভাল রেজাল্ট করতে হবে। কিন্তু আশ্চর্যজনক এই মিষ্টি খাওয়ানোর বিষয়টা কিছুতেই তার মনে থাকে না। একবার যদি মনে থাকত, সে ইচ্ছা করেই খারাপ পরীক্ষা দিত।

প্রশ্ন করে নিজেকেই। আচ্ছা দেশে হাজার হাজার মেধাবী থাকতে সে কেন চান্স পেল.? এতো এতো মেডিকেল কলেজ থাকতে এই মেডিকেল কলেজই বা কেন.?

**********

আর ভাল লাগে না তমালের। ক্লাসে দাঁড়িয়ে যায় হঠাৎ। স্যার জিজ্ঞেস করেন :

- কি ব্যাপার.? তুমি কিছু বলবে ?

- শরীরটা ভাল লাগছে না স্যার। চলে যেতে চাই।

সাইকিয়াট্রির টিচার। ভাল করে তাকালেন মুখের দিকে। কি বুঝলেন কে জানে ?? বললেন :

- ঠিক আছে যাও।

বাইরে বেরিয়ে আসে তমাল। মনটা বিষন্ন। চোখ দুটি ঝাপসা। মনে হয় যেন একটা চক্রের মধ্যে পড়েছে সে। প্রক়তির নিষ্ঠুর চক্র।

বিষয়: বিবিধ

১০৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File